সিরাজগঞ্জের ফুটবল মানচিত্রে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে নামটি নিরব অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে আলো ছড়িয়েছে, তিনি মাহবুব আলম পিয়ার। মাঠে কখনো ফরোয়ার্ড, কখনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড—দুই পজিশনেই সমান দক্ষতা দেখিয়ে বহু ম্যাচে দলকে রক্ষা করেছেন, গোল করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ এই লড়াকু ফুটবলারের পথচলা শুরু হয়েছিল স্কুলের ছোট্ট মাঠে, অজান্তেই বড় স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে।
শুরুটা স্কুলের মাঠে
বিএল সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী পিয়ার তখনও বুঝতেন না যে ফুটবল একদিন তার জীবনকে বদলে দেবে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে আন্তঃস্কুল ফুটবল লিগে অংশগ্রহণ ছিল তার প্রথম বড় মঞ্চ। সেখানেই তার প্রতিভার ঝলক প্রথম নজরে আসে কোচ–সিনিয়রদের।
এরপর মাসব্যাপী জেলা ক্রীড়া সংস্থার ফুটবল ক্যাম্পে অংশ নিয়ে তিনি আরও পরিণত হন, বড়দের সঙ্গেই তৈরি হয় তার ফুটবল চরিত্র। ধীরে ধীরে সিরাজগঞ্জ ফুটবলের পরিচিত মুখে পরিণত হন তিনি।

ফুটবল–পড়াশোনা—দুই ফ্রন্টেই সফলতা
ফুটবলের পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ছিলেন মনোযোগী। বিএল সরকারি স্কুলে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সুনাম ছিল তার। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি আরও এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। পরিবারের সমর্থন, এলাকার বড় ভাইদের পরামর্শ আর বিকেএসপির খেলোয়াড় সৈকতের উৎসাহে তিনি ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন সিরাজগঞ্জ কালেক্টরেট স্কুলের শারীরিক শিক্ষা বিভাগে।
শিক্ষকতা, পড়াশোনা আর খেলাধুলা—তিনটিকেই সামলাতে সামলাতে তিনি হয়ে ওঠেন জেলার সেরা ক্রীড়াবিদদের একজন।
প্রতিভা ছিল, সুযোগ হয়নি জাতীয় পর্যায়ে
১৫–১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহুবার নিজেকে প্রমাণ করলেও জাতীয় পর্যায়ে ওঠার মতো সুযোগ তার সামনে খুব একটা আসেনি। অথচ তার নৈপুণ্য, ম্যাচ রিডিং, ঠান্ডা মাথার খেলা এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা যেকোনো দলকে সমৃদ্ধ করতে পারত।
খেলোয়াড়ি জীবনের পাশাপাশি তিনি কোচ হিসেবেও নিজেকে গড়ে তোলেন। সি-লাইসেন্স পাওয়া গ্রাসরুট কোচ হিসেবে অনেক তরুণ ফুটবলারকে পথ দেখিয়েছেন, তৈরি করেছেন পরবর্তী প্রজন্ম।
২০২৫ সালের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ—উজ্জ্বলতা, অর্জন এবং হতাশা
তারুণ্যের উৎসব জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ–২০২৫ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ফুটবলে নতুন জোয়ার আসে। এই প্রতিযোগিতায় পিয়ারের পারফরম্যান্স ছিল দলের সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি। তিনি হন জেলার সেরা খেলোয়াড়। তার নেতৃত্ব আর কঠোর পরিশ্রমে সিরাজগঞ্জ প্রথমবারের মতো ফাইনালে পৌঁছে।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—অতিরিক্ত হলুদ কার্ডের কারণে ফাইনালে খেলতে পারেননি তিনি। তার অভিজ্ঞতা ও স্থিরতা সেই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খুব দরকার ছিল। অনেকে মনে করেন, পিয়ার মাঠে থাকলে ম্যাচের গল্পটা অন্যরকম হতে পারত। শেষ পর্যন্ত রানার্সআপ হয়ে থামতে হয় সিরাজগঞ্জকে।
এই হার ছিল শুধু ম্যাচের হার নয়—এটি ছিল সিরাজগঞ্জের হাজারো সমর্থকের স্বপ্নভঙ্গ। আর সেই ব্যথা পিয়ারও অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে।
নীরব বিদায়—দায় নয়, দায়িত্ববোধ
ফাইনালে খেলার সুযোগ না পাওয়া, দলের ব্যর্থতা এবং নিজের প্রতি বাড়তি প্রত্যাশার চাপ—সব মিলিয়ে পিয়ার মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পরই ঘোষণা দেন—তিনি আর জেলা দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন না।
তিনি বলেন, “আমি কাউকে দায় দিই না। শুধু মনে হয়, দায়িত্ববোধের জায়গায় হয়তো আর সেরাটুকু দিতে পারব না। আমার কোচ, ম্যানেজার সবার কাছে দোয়া চাই।”
এ যেন এক ফুটবলারের নীরব বিদায়ের ঘোষণা। যিনি দীর্ঘদিন পরিশ্রম করেছেন, স্বপ্নের জন্য লড়েছেন, জেলাকে গর্বিত করেছেন—তিনি চুপচাপ সরে দাঁড়ালেন।
জেলা ফুটবলের অমূল্য সম্পদ—গোল, সমর্থন আর স্মৃতিগুলো
পিয়ার শুধু খেলার নেতৃত্বই দেননি, বরং মাঠে করেছেন অসংখ্য গোল। কখনো প্রয়োজনের মুহূর্তে তার এক গোল বদলে দিয়েছে ম্যাচের রং, কখনো তার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের ভূমিকা দলকে বাঁচিয়েছে বিপদ থেকে।
তার গোল, তার লড়াই, তার দৃঢ়তা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সিরাজগঞ্জ ফুটবলের অন্যতম সেরা সৈনিক।
ফুটবলের পাশাপাশি প্রথম বিভাগে ক্রিকেটার
পিয়ার শুধু ফুটবলেই নয়—ক্রিকেটেও সমান পারদর্শী। তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছেন। ব্যাট–বল হাতে মাঠে তার উপস্থিতিও ছিল প্রশংসনীয়। বহুমুখী প্রতিভার এই ক্রীড়াবিদের জন্য খেলাধুলা ছিল শুধু পেশা নয়—একটি অনুভব, একটি জীবনধারা।
শেষবিন্দু নয়—অনুভবের ধারাবাহিকতা
আজও তিনি নিয়মিত খেলেন, কোচিং করেন, তরুণদের অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সি না গায়ে জড়াতে পারার আক্ষেপটি তাকে আজও তাড়া করে।
মাহবুব আলম পিয়ার সিরাজগঞ্জ ফুটবলের এক নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক—যিনি হয়তো জাতীয় দলে সুযোগ পাননি, কিন্তু মানুষটির প্রতি জেলার ভালোবাসা অটুট। তার স্বপ্ন হয়তো তিনি পূরণ করতে পারেননি, কিন্তু তার হাত ধরে যে অসংখ্য তরুণ ফুটবলার জন্ম নেবে—তাদের কেউ একজন হয়তো একদিন সেই স্বপ্ন পূরণ করবে।
Tags: জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, মাহবুব আলম পিয়ার, সিরাজগঞ্জ জেলা ফুটবল দল