সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান বাচ্চু শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি ব্যবসায়ী সমাজের নিরাপত্তা, বিশ্বাস ও প্রেরণার অন্যতম প্রতীক। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা থেকে শুরু করে করোনা মহামারি- প্রতিটি দুর্যোগকালেই তিনি ছিলেন মানুষের পাশে।
আগামী ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ চেম্বার নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ব্যবসায়ী সমাজের প্রত্যাশা, তার পুরোনো অভিজ্ঞতা এবং নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কথা বললেন ‘সিরাজগঞ্জ ইনফো’ এর সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন সিরাজগঞ্জ ইনফো সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল সাফি।
——————————————–
সিরাজগঞ্জ ইনফো: রাজনৈতিক হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে চেম্বারের নেতৃত্বে কীভাবে এলেন এবং আবারও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া বিষয়ে আপনার মতামত কী?
সাইদুর রহমান বাচ্চু: ৫ আগস্টের পরে আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন রাজনৈতিক অচলাবস্থায় চেম্বার বহুদিন বন্ধ ছিল। ব্যবসায়ীরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত, যোগাযোগহীন ও অসহায় অবস্থায় ছিলেন। তখন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ছিল, তখন আমি ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াই। চেম্বারকে আবার চালু করি, উন্মুক্ত করি এবং সব সদস্যকে সমান সুযোগ দেই।
বিগত মাসগুলোতে আমার কর্মতৎপরতায় ব্যবসায়ীরা আমাকে বলেছেন-‘আপনি না থাকলে আমাদের কথা কেউ বলবে না।’ এই আস্থা-এই বিশ্বাসই আমাকে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়েছে। আমার লক্ষ্য-ব্যবসায়ীদের অধিকার সুরক্ষিত করা এবং সিরাজগঞ্জের অর্থনীতিকে জাতীয় মানচিত্রে আরও শক্ত অবস্থানে নেওয়া।
সিরাজগঞ্জ ইনফো: আপনি বলছেন ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আপনি ব্যবসায়ীদের পাশে ছিলেন। একটু বিস্তারিত বলুন—কীভাবে তাদের পাশে ছিলেন এবং সেটা কি আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাতেও আছে?
সাইদুর রহমান বাচ্চু:
৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক নয়; ব্যবসায়ী সমাজের জন্য ছিল ভয়, অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার সময়। তখন অনেকেই দোকানপাট খুলতে ভয় পেয়েছেন, পণ্যের পরিবহন ব্যাহত হয়েছে, ব্যবসার পরিবেশ বিশৃঙ্খল ছিল। এ সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মাঠে থেকেছি-তাদের নিরাপত্তা, তাদের দোকান-বাণিজ্যের অবস্থা, বাজারের স্বাভাবিকতা-সবকিছু ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি।
প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের নিরাপদে বাণিজ্য চালানোর পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য যা যা দরকার ছিল, করেছি। সার্বিকভাবে ব্যবসায়ীরা দুর্দিনে যাকে তাদের পাশে পেয়েছেন, সেই ব্যক্তি আমি।
এ অভিজ্ঞতা আমাকে আরও দৃঢ় করেছে- আমি চাই ভবিষ্যতেও ব্যবসায়ীদের পাশে একইভাবে থাকব।

সিরাজগঞ্জ ইনফো: আপনার অতীত কর্মজীবন ও মানবিক উদ্যোগগুলো ব্যবসায়ীদের মাঝে আপনাকে জনপ্রিয় করেছে—এ নিয়ে কিছু বলবেন?
সাইদুর রহমান বাচ্চু:
মানুষের পাশে দাঁড়ানো- এটাই আমার রাজনীতি ও জীবনের মূল শিক্ষা। সেই ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় শহরজুড়ে শুধু পানি আর অসহায় মানুষ। ভদ্রঘাট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নোঙ্গরখানা থেকে রুটি, খাবার এনে আমি মহল্লা-মহল্লায় দরজায় দরজায় পৌঁছে দিয়েছি। পরবর্তীতে রোগবালাই থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মেডিকেল ক্যাম্প করেছি, ডাক্তার এনেছি, বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েছি।
আর করোনা মহামারি শ্রমজীবী, দিনমজুর ও কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। এগুলো কোনোটাই প্রদর্শনের জন্য নয়-এটা ছিল নৈতিক দায়িত্ব।
বন্যা, সামাজিক দুর্যোগ এবং সংকটকালে আমি শুধু রাজনৈতিক কর্মী বা ব্যবসায়ীদের নেতা নই-এই শহরের একজন সন্তান হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য মনে করি। এই বিশ্বাসই আমাকে জনপ্রিয় করেছে বলে আমি মনে করি।

সিরাজগঞ্জ ইনফো: চেম্বারের দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার পরে আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কী কী পরিবর্তন এসেছে?
সাইদুর রহমান বাচ্চু: যখন আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি, চেম্বারে গণতন্ত্র ছিল না, স্বচ্ছতা ছিল না, অংশগ্রহণ ছিল না। ১৩ বছর চেম্বার ছিল চিহ্নিত কিছু ফ্যাসিস্টদের হাতে জিম্মি, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ঘর থেকেও ছিলেন বঞ্চিত।
আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে চেম্বারকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছি, দল-মত-গ্রুপ নির্বিশেষে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেছি এবং প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছি।
ব্যবসায়ীরা এক কথায় বলেছেন-‘অনেকদিন পর আবার চেম্বারে প্রাণ ফিরেছে।’ সম্প্রতি চেম্বারের একটি ওয়েবসাইট তৈরিসহ জেলার ব্যবসাকে একটি জাতীয় পর্যায়ের রুপ দিতে কারিগরি উন্নয়নে হাত দিয়েছি।
সিরাজগঞ্জ ইনফো: সিরাজগঞ্জ এখন শুধু একটি জেলা নয়—বিসিক, ইকোনমিক জোনসহ নানা অর্থনৈতিক বলয়ের কারণে জাতীয় গুরুত্ব পেয়েছে। আপনি কি মনে করেন চেম্বার এই পরিবর্তনকে যথেষ্টভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাইদুর রহমান বাচ্চু: সিরাজগঞ্জকে ঘিরে এখন যে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে—এটি দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্র বদলে দেওয়ার মতো সম্ভাবনা রাখে। বিসিক, ইকোনমিক জোন, শিল্প কারখানা, নদীভিত্তিক বাণিজ্য, সিরাজগঞ্জ-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে—সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জ আর কোনও সাধারণ জেলা নয়। এটি emerging national economic hub.
কিন্তু একজন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শুধু বিগতগুলোর কথা বলা নয়—এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে জাতীয় পর্যায়ে জোরালো দাবি তোলা জরুরি। সিরাজগঞ্জের বিনিয়োগ পরিবেশ, শিল্পায়ন, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের সুযোগ, কৃষিভিত্তিক খাদ্যশিল্প—সবকিছু নিয়ে আমি ইতোমধ্যেই কাজ করছি।
আমার লক্ষ্য হলো জাতীয় পর্যায়ে সিরাজগঞ্জকে একটি ‘Economic Identity’ দেওয়া। যাতে ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা এবং শিল্পকারখানার মালিকরা সিরাজগঞ্জকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করেন। চেম্বারের নেতৃত্বে থেকে আমি সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি।
এবিষয়ে আমি ইতিমধ্যে জেলার ব্যবসায়ী ও চেম্বারের ভোটারদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি।
সিরাজগঞ্জ ইনফো: সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বার্তা দিয়েছেন—সেগুলো একটু বিস্তারিত বলবেন?
সাইদুর রহমান বাচ্চু: জেলার ব্যবসায়ী ও চেম্বারের ভোটারদের আমি মোটাদাগে স্পষ্ট ৩টি বার্তা দিয়েছি, সেগুলো হলো-
বার্তা ১. ব্যবসায়ীদের পাশে থাকা ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখা।
৫ আগস্টের পর ব্যবসায়ীদের দোকানপাট, মার্কেট এবং জীবন–জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। আমি দিনরাত পাশে থেকেছি। ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো অস্থিরতা এলে আমি তাদের পাশে থাকব। আমি চাই ব্যবসায়ীরা এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকুক- ‘বাচ্চু ভাই আছেন-আমরা নিরাপদ।’
বার্তা ২. প্রশাসনের সঙ্গে শক্তিশালী লিয়াজো
ব্যবসায়ীদের কর, মাসুল, ট্রেড লাইসেন্স, আইনশৃঙ্খলা, বাজার ব্যবস্থাপনা- এসব বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ প্রয়োজন। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- ব্যবসায়ী সমাজের স্বার্থ রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও সরকারি অফিসগুলোর সঙ্গে আরও সমন্বয় বাড়াবো, যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।
বার্তা ৩. সিরাজগঞ্জকে জাতীয় অর্থনৈতিক শক্তিক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা
সিরাজগঞ্জ জেলা এখন বিসিক শিল্পপার্ক, সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন ও জেলায় ছড়িয়ে থাকা
বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্য ও মেজর হাইওয়ে নেটওয়ার্কের কারণে সব মিলিয়ে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জেলা।
আমি পরিকল্পনা করছি, সিরাজগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যকে জাতীয়ভাবে (রাজধানীতে) তুলে ধরবো, বিনিয়োগ আনতে কাজ করবো, নতুন শিল্প খাতের সুযোগ তৈরি করতে চেষ্টা করবো, উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সুবিধা বৃদ্ধি করা সহ নানা প্রয়োজনে ভবিষ্যত রাজনৈতিক ও নির্বাচিত সরকারের পলিসিতে যুক্ত থাকার চেষ্টা করবো।
সিরাজগঞ্জ এখন আর ছোট জেলা নয়- এটি বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক শক্তি—এ শক্তিকে আরও উঁচুতে নিতে চাই চেম্বারের নেতৃত্ব থেকে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- চেম্বারকে একটি আধুনিক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

সিরাজগঞ্জ ইনফো: ব্যস্ত সময়েও কথা বলার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সাইদুর রহমান বাচ্চু: আপনাদের অনেক ধন্যবাদ এবং আপনাদের মাধ্যমে জেলার ব্যবসায়ী ও সিরাজগঞ্জ শহরের সাধারণ মানুষকে আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
Tags: সাইদুর রহমান বাচ্চু, সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স