সিরাজগঞ্জ কোনো সাধারণ জেলা নয়। ব্রিটিশ আমলে কলকাতার সঙ্গে সরাসরি রেলসংযোগ, যমুনাকেন্দ্রিক নৌ–বাণিজ্য এবং পূর্ব-বাংলা ও আসাম অঞ্চলের বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে সিরাজগঞ্জকে একসময় “দ্বিতীয় কলকাতা” বলা হতো। পাটশিল্প, খাল-বন্দর, গুদামঘর এবং রেল–নৌ যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই শহরটি বিংশ শতকের প্রথমভাগেই বাংলা অঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্যিক শক্তি হয়ে ওঠে।
বিভাজন–পরবর্তী প্রশাসনিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই অগ্রযাত্রা কিছুটা স্তিমিত হলেও, গত এক দশকের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সিরাজগঞ্জকে আবারও দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে কেন্দ্রীয় অবস্থানে নিয়ে আসছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: শিল্পায়নের নতুন ভিত্তি
যমুনা সেতুর ডাবল লাইন রেল সংযোগ, চারলেন সড়ক উন্নয়ন, নদীভিত্তিক স্বল্প ব্যয়ী পরিবহন এবং উত্তরাঞ্চলকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করার বৃহৎ প্রকল্পগুলো সিরাজগঞ্জকে একটি আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত করছে। সয়দাবাদে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি শিল্পাঞ্চল সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন (প্রায় ১,০০০ একর), ৪০০ একর আয়তনের আধুনিক বিসিক শিল্পপার্ক, পরিকল্পনাধীন ইপিজেড, ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (ICD), যমুনা নদীকেন্দ্রিক রিভার পোর্ট—সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জ এখন বাংলাদেশের পরবর্তী শিল্প বিপ্লবের অন্যতম ফ্রন্টলাইনে।
অতিরিক্ত সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে উদীয়মান হচ্ছে সিরাজগঞ্জের পর্যটন খাত। যমুনার চরাঞ্চল, নদীভ্রমণ, রবীন্দ্রকানন, উল্লাপাড়া–শাহজাদপুর সাংস্কৃতিক বৃত্ত—এগুলো পর্যটন অর্থনীতিতে নতুন গতি আনতে পারে।
সুযোগের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও কম নয়
অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিসিক শিল্পপার্কে প্লট হস্তান্তর হলেও পূর্ণাঙ্গ ইউটিলিটি সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। ইকোনমিক জোনে বিদ্যুৎ–গ্যাস সংযোগ পুরোপুরি কার্যকর নয়। দক্ষ জনশক্তি, শ্রমিক–বাসস্থান, শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তা—এসব ক্ষেত্রেও ব্যাপক কাজ বাকি।
এগুলো সমাধান করতে পারলে সিরাজগঞ্জ শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং জাতীয় শিল্প উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
চেম্বার নির্বাচনের গুরুত্ব: আগামী দশকের উন্নয়ন যাত্রার ভিত্তি
এমন সময়েই সামনে এসেছে সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন ২০২৫। এটি কোনো সাধারণ নির্বাচন নয়; বরং আগামী দশকের শিল্প–বাণিজ্যিক রূপরেখা নির্ধারণের একটি কৌশলগত মুহূর্ত।
চেম্বারের নেতৃত্ব যদি উদ্ভাবনী, জবাবদিহিমূলক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং শিল্পবান্ধব নীতি গ্রহণে সক্ষম হয়, তাহলে সিরাজগঞ্জে আগামী ১০ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫–৭ লাখ কর্মসংস্থান সৃজনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্যও তৈরি হবে নতুন বাজার, রপ্তানি–ভিত্তিক শিল্পে প্রবেশের সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণের অনুকূল পরিবেশ।
এ ছাড়াও চেম্বারের কার্যকর নেতৃত্ব স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিধিত্ব করবে, নীতি–সংস্কারের দাবি তুলে ধরবে এবং সিরাজগঞ্জকে একটি আধুনিক ব্যবসাবান্ধব অঞ্চলে রূপান্তর করার পথপ্রদর্শক হবে।
শিল্পনগরীর পথে সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জের সম্ভাবনা স্থানীয় উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আসলে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ, ঢাকা–কেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির চাপ কমানোর কৌশল এবং দেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণের একটি নতুন উপকূল।
রিভার–পোর্ট, রেলপথ, শিল্পাঞ্চল, কৃষি–প্রক্রিয়াজাত শিল্প, গার্মেন্টস ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক্স, খাদ্যশিল্প—সব ক্ষেত্রেই সিরাজগঞ্জ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির একটি নতুন কেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
সামনে যে বিপুল বাণিজ্যিক ও শিল্প সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী নেতৃত্ব, সমন্বিত নীতি এবং আধুনিক ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। সিরাজগঞ্জ চেম্বারের আসন্ন নির্বাচন তাই শুধুই একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি আগামী দশকের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং শিল্পায়নের দিকনির্দেশনা নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।